ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের দ্বারা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয় রাশিয়াকে । তবে বিগত কয়েক বছরের ব্যালেন্স শীট দেখলেই বুঝা যায় রাশিয়া এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো । যদিও প্রথম দিকে রাশিয়ান “রুবল” তার মূল্য হারাতে থাকে ।
অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দেবার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ১ মার্কিন ডলারের বিপরীতে রাশিয়ান রুবল ১৫৪ তে পৌঁছে । যার ফলে রাশিয়ানদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়তে শুরু করে । অনেক রাশিয়ানরাই ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করতে শুরু করেন । এই অতিরিক্ত অর্থই দেশটিতে পণ্যের মূল্যকে বৃদ্ধি করতে সহায়তা করে । দেশটির জনগণ রাশিয়ান অর্থনীতিতে বিশ্বাস হারাতে শুরু করেন । এমন অবস্থায় রাশিয়ান সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন । তারা রাশিয়ান রুবলকে স্থির রাখার জন্য স্বর্ণের সাথে রুবলের সম্পর্ক স্থাপন করেন । এখন এই স্বর্ণের বিপরীত বিটকয়েনের বিরুদ্ধে কি রুবলের সম্পর্ক স্থাপন করা যেত কিনা সেটা নিয়েই কয়েন আলাপের আজকের আলোচনা ।
স্বর্ণ ও বিটকয়েনের পার্থক্য
বিস্তারিত আলোচনায় যাবার পূর্বে আমারা একটু স্বর্ণ ও বিটকয়েনের মাঝে পার্থক্য দেখে নেই । আদিমকাল থেকেই স্বর্ণ বহুল প্রচলিত একটি মূল্যবান ধাতু হিসেবে পরিচিত । এটির প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও সম্মাননার কমতি নেই । বলতে গেলে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন অথচ স্বর্ণ সম্পর্কে জানেন না এমন মানুষ খুজে বের করা নেহাতই একটি কষ্টসাধ্য ব্যাপার । অন্যদিকে বিটকয়েন মাত্রই শুরু হওয়া সম্পূর্ণ নতুন একটি ইন্ডাস্ট্রি । এটা সম্পর্কে এখনও অনেক দেশই বা মানুষই ভালভাবে কিছুই জানে না । ৭.৭৫৩ বিলিয়ন মানুষের মাঝে কেবলমাত্র ১১৪ মিলিয়ন মানুষ বিটকয়েনে বিনিয়োগ করেছেন । রাশিয়ার মোট জনসংখ্যা এর থেকে কিছুটা বেশি, অর্থাৎ ১৪৪.১ মিলিয়ন । এমতাবস্থায় বিটকয়েনের বিরুদ্ধে রাশিয়ান রুবলকে সমন্বয় করাটা কি কোনভাবেই যৌক্তিক হতে পারতো ?
বিটকয়েনের প্রতিকূলতা
নিঃসন্দেহে বিটকয়েন প্রচলিত ফিয়েট মুদ্রা থেকে অনেকটাই উত্তম । তবে বর্তমানে এটিকে আমরা কোনভাবেই মুদ্রারূপে ব্যবহার করতে পারবো না । আবার এটিকে মুদ্রার মান রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যবহার করাটাও অনেকটাই কষ্টসাধ্য ব্যাপার । যার ফলে সকলেই এটাকে মুদ্রার রূপে না দেখে অ্যাসেট বা সম্পদের রূপে দেখে । অনেকে বিনিয়োগকারীরাই এটাকে মুদ্রাস্ফীতি থেকে নিজেদের সম্পদকে রক্ষার ক্ষেত্রে একটি ভাল বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করেন । বর্তমানে এটিকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করাটাও বেশ কঠিন একটি ব্যাপার । মুদ্রার মান সবসময় স্থিতিশীল থাকাটা জরুরী । যেটা বিটকয়েনের ক্ষেত্রে বেশ জটিল একটি বিষয় । আবার এই অস্থিতিশীলতার কারনেই বিটকয়েনকে ব্যবহার করতে গেলে যেকোন এক পক্ষকে লোকসান গুনতে হবে । কম বেশি সকলেই “বিটকয়েন পিজ্জা দিবস” এর কথা শুনেছেন । অনেকেই সেই ১০ হাজার বিটকয়েনের বর্তমান বাজার মূল্য বের করেও দেখেছেন । আসলে এই সমস্যাটা এখনও সম্ভব । এটা সমন্বয় করাটা বেশ জটিল একটি কাজ । কারন বর্তমান ফিয়েট কারেন্সির তুলনায় বিটকয়েনকে পেমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করলে স্বল্প সময়ে হয়ত বিক্রেতার লোকসান হবে তবে মধ্যম বা দীর্ঘ মেয়াদে সেটা সব সময়ই ক্রেতার জন্য বড় ধরনের পার্থক্যের সৃষ্টি করবে ।
রাশিয়ার কি হতো ?
প্রশ্নটি এখনও থেকেই যায় যে আসলেও কি হতো । এখান সম্পূর্ণভাবে সত্য কোন কিছু আন্দাজ করাটা খুবই জটিল । কারন ঘটনাগুলো এখনও ঘটেনি । চলুন আমরা দেখে নেই কি ঘটতে পারতো ।
অল্প কিছু সময়ের জন্য ভাল হলেও রুবলের দরপতন অব্যহত থাকতো । কারন বর্তমানে বেশিরভাগ বিটকয়েনে বিনিয়োগকারীরাই হলো মার্কিনিরা । বেশ কয়েকটি মার্কিন ইন্সটিটিউটও বিটকয়েনে বিনিয়োগ করে রেখেছে । তাদেরকে নিজ ইচ্ছায় না হলেও মার্কিন সরকারের চাপে বিটকয়েন থেকে তাদের বিনিয়োগকে বিচ্ছিন্ন করতে হতো । তখন বিটকয়েনে ফ্রী ফল বা উচ্চ নিম্নগতির দরপতন দেখা দিতে পারতো ।
কেবলমাত্র মার্কিন ডলারের আধিপত্যের কারনে বেশ কিছু সময়ে অন্যান্য দেশকেও ক্ষতিগ্রস্থ হতে হয় । কারন মার্কিনিরা তাদের লাভের জন্য হরহামেশা ডলারকেও একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে । যেটা অন্যান্য দেশকে অনেকটা বাধ্য হয়েই মেনে নিতে । যার ফলে মার্কিনিরা এখনও সর্বোচ্চ শক্তিধর একটি দেশ । এমতাবস্থায় বুঝতেই পারছেন বিটকয়েনকে অনেকটাই দরপতনের দিকে নিয়ে যেতে পারতো ।
এমন পরিস্থিতিতে বিটকয়েনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হতো । এই নিষেধাজ্ঞার জন্য বিটকয়েন নেটওয়ার্কে হ্যাকারদের আনাগোনা বেড়ে যেতো । বিভিন্ন মাইনিং কোম্পানি বিটকয়েন মাইনিং থেকে বেড়িয়ে যেত । যা বিটকয়েনের সুরক্ষা প্রতিবেষ্টনিকে খুবই ভয়াবহ দিকে নিয়ে যেতে পারতো ।
উপরের ঘটনাগুলো ছাড়া আরও অনেক ঘটনাই রয়েছে যা এখানে আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছে না । আসলে এই তিনটি ঘটনাই অন্যান্য ঘটনা থেকে সব থেকে বড় ক্ষতি সাধন করতো বিটকয়েনের । অন্যান্য ঘটনাগুলোও এই তিনটি ঘটনার জন্য সংঘটিত হতো । আলোচিত এই তিনটি ঘটনা যদি সত্য হতো তাহলে বিটকয়েন নামের এই ক্রিপ্টোকারেন্সিটিও ধ্বংস হয়ে যেত । যার সাথে সাথে রাশিয়ান রুবলেরও অবস্থা ধ্বংসের দিকে চলে যেত । অনেকেই তখন ধারনা করেন রাশিয়া বিটকয়েনকে পেমেন্ট সিস্টেম হিসেবে ব্যবহার করবে । আসলে তারা সম্পূর্ণ একটি বানোয়াট গল্প বানিয়ে ছিলো । কোন দেশের সরকারই চাইবে না যেটা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে এমন কিছু ব্যবহার করতে ।
আপনারাও বিটকয়েনে বিনিয়োগ করার সময় অনেকেই আকাশচুম্বি স্বপ্ন দেখেন । আসলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এই আকাশচুম্বি স্বপ্নগুলোই নিয়ে আসতে পারে “কালবৈশাখী” ঝড় । যা আপনার বর্তমান জীবনব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্থ করবে । “হতে পারে” শব্দটি কখনও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য হতে পারে না । তাই বিনিয়োগের পূর্বে আসলেই একটু ভেবে দেখবেন কেন বিনিয়োগ করবেন ।